ত্যাজ্যপুত্র, সন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা আইনগত বৈধ না অবৈধ?

বহুল প্রচলিত ত্যাজ্যপুত্র /ত্যাজ্যকণ্যা শব্দটি অধিকাংশ মানুষের কাছে পরিচিত।  বিশেষ করে আমাদের দেশে সিনেমা/নাটক ক্ষেত্রে এই শব্দটি বহুকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। এর ফলে আমাদের অনেকের ধারণা ত্যাজ্যপুত্র/ত্যাজ্যকণ্যা করলে পারিবারিক সম্পর্ক ও সম্পত্তি থেকে পুরাপুরি বঞ্চিত হয়। এই নিয়ে সমাজে রয়েছে নানান আলোচনা-সমালোচনা। তবে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ত্যাজ্যপুত্র/ত্যাজ্যকণ্যা সম্পর্কে বলছে ভিন্ন কথা!

ত্যাজ্যপুত্র/ ত্যাজ্যকণ্যা কি? 

=> ত্যাজ্যপুত্র দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত একটি সামাজিক ধারণা যার আইনে কোন অস্তিত্ত্ব নেই। সাধারণত মা-বাবার অবাধ্য সন্তানদের প্রতি ক্ষোপের বহিঃপ্রকাশ। সন্তান মা-বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চললে বা সঠিক পথে আনা যায় না তখন মা-বাবা ত্যাজ্যপুত্র/ত্যাজ্যকণ্যা করবো বলে ভয়ভীতি দেখান।  

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ত্যাজ্যপুত্র সম্পত্তিতে ওই ব্যক্তির অধিকার হারায়। ত্যাজ্যপুত্র সাধারণত মৌখিকভাবে করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে পিতা হলফনামা (এভিডেভিড) করে তাহার সম্পত্তিতে ওই সন্তানের সম্পত্তির অধিকার বাতিল ঘোষণা করেন। আবার অনেকেই শর্তসাপেক্ষে ত্যাজ্য করেন। তবে সন্তান তাহার বাধ্যমত হয়, তবেই ওই ঘোষণা বাতিল করা হইবে। বস্তুত সন্তানের বেপরোয়া আচরণে মা-বাবা অতিষ্ঠ হয়েই এ ধরনের কঠিন সিদ্ধান্ত নেন।

সামাজে বিত্তশালী পরিবারে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে বেশি দেখা যায়। ত্যাজ্যপুত্র একটি ভ্রান্ত ধারণা, যা বাংলাদেশের কোনো আইনে বিধৃত নেই। প্রকৃত মুসলিম আইন না জানার কারণে এমন একটি বিষয় সমাজে প্রচলিত। ফলশ্রুতিতে নানা রকম সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশে উত্তরাধিকারের বিষয়গুলো মূলত মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য নিজস্ব ধর্মীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মুসলিম আইন অনুযায়ী ত্যাজ্যপুত্র মাধ্যমেই উত্তরাধিকার সৃষ্টি বা ধ্বংস হয় না। ১৯২৫ সালের উত্তরাধিকার আইন ( The Succession Act, 1925) এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অপরদিকে, হিন্দু আইনে ত্যাজ্যপুত্র ধারণাটা কিছুটা শর্তসাপেক্ষে সম্পত্তির অধিকার হইতে বঞ্চিত করে।

=> মুসলিম আইনে সন্তানের উত্তরাধিকারের জন্মসূত্রে নিধারিত যা কোনভাবেই তাকে বঞ্চিত করবে না। পিতা-মাতা চাইলে তাদের সম্পত্তি  বেঁচে থাকা অবস্থায় দান /হেবা করে যেতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে ১৯০৮ সালের রেজিষ্ট্রেশন আইন অনুসারে করতে হবে।  রেজিস্ট্রেশন বাধ্যমূলক। তবে সেক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি দান করতে পারে। অবশিষ্টাংশ সম্পত্তি থেকে থাকলে সেই ক্ষেত্রেই সন্তান পাবে। 

=> তবে মুসলিম আইনে কয়েকটি ব্যতিক্রমের কথা উল্লেখ রয়েছে, নরহত্যাজনিত অপরাধে অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশত কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে অথবা যদি সে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে তাহলে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত হবে ।

ত্যাজ্যপুত্র ধারণাটি বাংলাদেশে মুসলমানদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় বাবার মৃত্যুর পর অন্য উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তি বণ্টনের সময় অংশ দিতে অনিচ্ছুক হয়। অপরদিকে, প্রকৃত আইনের অজ্ঞতার কারণে গ্রাম্য-সালিশকারীদের ভুল সিদ্ধান্ত দিতে দেখা যায়।

এর ফলে মুসলিম আইনের লঙ্ঘন ঘটে। এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এক্ষেত্রে ১৮৯৩ সালের বাটোয়ারা আইনে ৫০০ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে দেওয়ানি আদালতে বাটোয়ারা মামলা করতে পারবেন সংশ্লিষ্ট এখতিয়ার সম্পূর্ণ আদালতে।

Leave a Comment